দেশের ৫টি ব্যাংক থেকে প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় বিসমিল্লাহ গ্রুপের বিষয়ে আগামী সপ্তাহে প্রতিবেদন জমা দেবে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।
টেরিটাওয়েল (তোয়ালে জাতীয় পণ্য) উৎপাদক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশে বেশ পরিচিত বিসমিল্লাহ গ্রুপ। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে ৫টি ব্যাংক থেকে প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে জানান, দুদকের অনুসন্ধান দল প্রতিবেদন তৈরির কাজ প্রায় শেষ করেছে। আসছে সপ্তাহের শেষ দিকে প্রতিবেদন কমিশনে উপস্থাপন হতে পারে। কমিশন অনুমোদন দিলে যে কোন সময় মামলা করতে পারে।
তিনি আরো জানান, অনুসন্ধান প্রতিবেদনে ৪০ থেকে ৪৫ জনের বিরুদ্ধে ৮ থেকে ১০ টি মামলা করার সুপারিশ থাকছে। পরবর্তীতে বাড়তে পারে এ সংখ্যা।
আসামিদের তালিকায় বিসমিল্লাহ গ্রুপের ৫টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও পাঁচ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নাম রয়েছে।
বিসমিল্লাহ গ্রুপের পরিচালনা পর্ষদের আসামিরা হলেন- বিসমিল্লাহ টাওয়েলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান নওরিন হাসিব, ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবিদা হাসিব, পরিচালক নাহিদ আনোয়ার খান, খন্দকার মইনুদ্দিন আশরাফ ও সারোয়ার জাহান।
আলপা কম্পোজিট টাওয়েলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান নওরিন হাসিব, ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী, পরিচালক শফিকুল আনোয়ার চৌধুরী, আবুল খায়ের আবদুল্লাহ, লুনা আবুদল্লাহ, আলমগীর হোসাইন, হেনা সেরনিয়াবাত এবং সাইদ মাহমুদ মোসতাকি।
শাহারিশ কম্পোজিট টাওয়েলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান শফিকুল আনোয়ার চৌধুরী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী ও পরিচালক নওরিন হাসিব।
সেহরিন টেক্সটাইল ইন্ডাসট্রিশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান শফিকুল আনোয়ার চৌধুরী, পরিচালক মির মোহাম্মদ ইয়াকুব, মের্সাস কনিজ ফাতিমা, মির মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী, পরিচালক নওরিন হাসিব।
হিন্দুওয়ালী টেক্সটাইল লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য- শফিকুল আনোয়ার চৌধুরী, খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী, বেগম সরোয়ার জাহান, আলহাজ্ব নাদের জাহান বেগম, বেগম নাহিদ আনোয়ার, বেগম ফেরদৌস আনোয়ার এবং মিসেস শারমিন আনোয়ার।
এদের মধ্যে খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী, শফিকুল আনোয়ার চৌধুরী, নওরিন হাসিব ও নাহিদ আনোয়ার খান একাধিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। এ কারণে প্রায় প্রতিটি মামলায় আসামী হিসেবেই তাদের থাকছে।
অন্য একটি সূত্র জানায়, মামলায় ব্রাক ব্যাংকের এমডি (প্রাইম ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এমডি (প্রাইম ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি) এহসানুল হক এবং ব্যাংক এশিয়ার এমডি (প্রাইম ব্যাংকের সাবেক এসইভিপি) মাহমুদ হোসেনসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার নাম থাকতে পারে।
কারণ হিসেবে জানা যায়, এ তিন ব্যাংকের এমডিই জালিয়াতির সময় প্রাইম ব্যাংকের প্রধান শাখায় কর্মরত ছিলেন। তারা বিসমিল্লাহ গ্রুপের বিল পার্চেজ অনুমোদনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মাত্রাতিরিক্ত বকেয়া থাকা সত্ত্বেও নতুন চুক্তির কাগজ পত্রে তাদের স্বাক্ষর পেয়েছে দুদক।
সর্বশেষ বিসমিল্লাহ গ্রুপের নামে নতুন করে ১৪২ কোটি টাকার বিল পার্চেজ রিনিউ হয়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে ওই সময় বিসমিল্লাহ গ্রুপের বকেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫০ কোটি টাকার উপরে। এই বিশাল অঙ্কের বকেয়া থাকার পরও ওই অর্থ ছাড় দেয়া হয়েছিল।
আরো জানা যায়, মূল জালিয়াত গ্রুপের এমডি খাজা সোলেমান আনোয়ার চৌধুরী। এবং তার সঙ্গে প্রতিটি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কিছু না কিছু সম্পৃক্ততা রয়েছে। জালিয়াতির মূল ঘটনাটি শুরু হয় ২০০৬ সালে। বিসমিল্লাহ গ্রুপ ওই বছর জুন-জুলাইয়ের দিকে জনতা ব্যাংক থেকে সরে গিয়ে প্রাইম ব্যাংক থেকে কন্ট্রাক্ট এলসিতে ঋণ নেয়া শুরু করে। এক্ষেত্রে তাদের এ কাজে সরাসরি সহায়তা করেন বর্তমানে ৩ ব্যাংকের এমডি যারা ওই সময় প্রাইম ব্যাংকের ডিএমডি ছিলেন। তাদের সাথে ছিলেন একই ব্যাংকের ২০-২২ শীর্ষ কর্মকর্তা।
দুদক সূত্র জানায়, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির পরিমাণ প্রাথমিকভাবে প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা জানা গেলেও দুদক টিমের প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে এ অর্থের পরিমাণ আরও কম হবে। কারণ, ইতোমধ্যেই সাউথইস্ট ব্যাংকের সঙ্গে লেন-দেন চুকিয়ে ফেলেছে বিসমিল্লাহ গ্রুপ। এছাড়া শাহজালাল এবং যমুনা ব্যাংকেও কিছু অর্থ সমন্বয় হয়েছে বলে জানা গেছে।
জালিয়াতির ঘটনায় সম্পৃক্ত মোট পাঁচটি ব্যাংক হলো- জনতা ব্যাংক, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক এবং প্রাইম ব্যাংক।
কমিশনের অনুসন্ধান টিম সম্পৃক্ত ব্যাংকগুলোর নথিপত্র পর্যালোচনা করে ইতোমধ্যেই শতাধিক ব্যাংক কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। যার মধ্যে প্রাইম ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে প্রায় ৩০ কর্মকর্তা রয়েছেন।
তবে এ গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিরা বিদেশ থাকার কারণে অনুসন্ধান টিমের কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে। বিদেশে থাকা এমডি, চেয়ারম্যান ও দুই পরিচালকসহ ওই কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে না পারায় জালিয়াতির অনেক তথ্যই অজানা থেকে যাচ্ছে।
বিসমিল্লাহ গ্রুপের প্রায় ১২শ’ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ২৬ ফেব্রুয়ারি পাঁচ সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করে দুদক।
দুদকের উপ-পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে এ অনুসন্ধান টিমের অন্য সদস্যরা হলেন- সহকারি উপ-পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম, গুলশান আনোয়ার প্রধান, উপ-পরিচালক সরদার মঞ্জুর আহমেদ এবং মো. আল আমিন।
মন্তব্য করুন