চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রতিদিন ১৩৫টি কারখানা প্লাস্টিকের বোতল ও জারে ‘পরিশোধিত’ পানি বাজারজাত করছে। তার মধ্যে মাত্র ১৫টি বিএসটিআইয়ের অনুমোদনপ্রাপ্ত। বৈধ এই ব্র্যান্ডগুলো হচ্ছে ডানকান, সিনমিন, ইয়েস, মুসকান, দাদা, আনন্দ, আরোয়া, ডক্টর ওয়াটার, মিম সুপার, আরিবা, আসিফ, বনফুল, কে ওয়াটার, নিউ জয় ও সাজিদ। বাকি ১২০ কারখানার বিএসটিআইর অনুমোদন নেই। অনুমোদনহীন কারখানাগুলোতে জার পরিষ্কারকযন্ত্র দূরের কথা, অধিকাংশেরই পানি পরিশোধনকারী ইউভি মেশিন নেই। এসব পানি অপরিশোধিত ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এতে মারাÍক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে নগরবাসী।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নগরীতে প্লাস্টিকের বোতল ও জারে খাবার পানি বিক্রি করে প্রায় ১৩৫টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ১৫টি ছাড়া বাকি ১২০টি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেই। অথচ তারা তাদের পানি ‘পরিশোধিত’ দাবি করে বাজারে বিক্রি করছে। আল্ট্রা ভায়োলেট রে (ইউভি) মেশিন ও রিভার্স অসমোসিসের মাধ্যমে পরিশোধন ছাড়াই ক্ষতিকর জীবাণুযুক্ত এ পানি বিক্রি করছে অবৈধ কারখানাগুলো। এসব কারখানায় পরিবেশগত পরিচ্ছন্নতাও মানা হয় না। শহরের বাসাবাড়ি, অফিস, নামি হোটেল রেস্তোরাঁয় ব্যবহার হচ্ছে এ পানি। অনুমোদনহীন এমনই একটি প্রতিষ্ঠান সেফ ড্রিংকিংস অ্যান্ড বেভারেজ। ‘আর্ক’ ব্র্যান্ড নামে পানি বাজারজাত করে প্রতিষ্ঠানটি। নগরীর মুরাদপুর ফরেস্ট রোডের ৪৩১/এ ঠিকানার কারখানা থেকে প্রতিদিন ৭০০-৮০০ জার পানি বাজারজাত করছে তারা। ১৯ লিটারের প্রতি জার পানির দাম ৪৫ টাকা। বিজ্ঞাপনে প্রতিষ্ঠানের মালিকের নাম উল্লেখ করা হয় ‘মোঃ জয়’। তবে ফোন করলে তিনি নিজের নাম ‘মঈনুল হোসেন আলী’ বলে জানান। পরিশোধিত পানি সরবরাহে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন না থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। নিজেকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে জানান, আমার প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন আছে। তা ছাড়া আমরাই তো কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে নগরীর বিভিন্ন পানিকারখানা পরীক্ষা করি। তবে সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট দফতরে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, এ নামে তাদের কোনো স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নেই। এরকম আরেকটি ব্র্যান্ড ‘পিপাসা’। আবদুল্লাহ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের এ কারখানা হালিশহর আবাসিক এলাকার ছদু চৌধুরী সড়কে অবস্থিত। অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানটি কোনো ধরনের মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই প্রতিদিন ৬০০-৭০০ জার পানি বাজারজাত করছে।
এ ছাড়া অনুমোদনহীন অন্য যেসব ব্র্যান্ডের পানি বাজারে অবাধে বিক্রি হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে চান্দগাঁও গোলাম আলী নাজিরপাড়ার ৪০৫১/বি ঠিকানার ‘কাউছার’, ফিরিঙ্গী বাজার এয়াকুব নগরের ১২ নম্বর বাসার ‘পদ্মা’, আবদুল মাবুদ সড়কের ‘একুশে প্লাস’, কালামিয়া বাজারের আয়েশা ভবনের ‘মিম’, আসকার দীঘির পশ্চিম পাড়, ৬৩ নম্বর হেম সেন লেনের ‘এইচ টু ও’, কেবি আমান আলী সড়কের আতুরার দোকান এলাকার ‘ক্লিন’, আতুরার ডিপো ৩৬৬/৪১০ নম্বর বাসার ‘মিস্টার পিওর’, ২৬২১/এ সৈয়দ শাহ সড়কের ‘ওরিয়েন্ট’, একই এলাকার ‘সাবা’, দামপাড়ার নুর আয়েশা ম্যানসনের ‘লারিবা’, খালাসি পুকুর পাড়ের আজিজ মার্কেটের ‘লিজেন্ড’, চর পাথরঘাটার কোয়াজনগর এলাকার ‘সাফা’, আগ্রাবাদের মৌলভীপাড়ার ‘অ্যাকুয়া ফ্রেশ’, চর চাকতাই ইসমাইল ফয়েজ সড়কের ‘মাইলো’, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বি ব্লকের ১৪ নম্বর সড়কের ১৬৭৯ নম্বর বাসার ‘দেশ’, পূর্ব বাকলিয়ার লতিফের হাট এলাকার ‘নূর-এ-মদিনা’ এবং হাটহাজারীর ইসলামিয়া হাটের ‘তারিফ’। এ ধরনের কারখানার সংখ্যা প্রায় ১২০টি।
বিএসটিআইয়ের সহকার পরিচালক কেএম হানিফ জানান, খাবার পানি পরিশোধন প্রক্রিয়ার প্রধান অংশটি হচ্ছে ইউভি মেশিনের ব্যবহার। এ মেশিনে অতিবেগুনি রশ্মির স্বল্পমাত্রার বিকিরণের সাহায্যে পানিতে থাকা আণুবীক্ষণিক জীবাণু ধ্বংস করা হয়। বিকিরণের প্রভাবে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, আণুবীক্ষণিক গুটিপোকার মতো জীবাণু ও শ্যাওলার ডিএনএ গুঁড়িয়ে যায়। ফলে বংশবিস্তার দূরের কথা, এরা নিজেরাই আর ক্ষতিকর থাকে না। তিনি বলেন, পাশাপাশি বারবার ব্যবহƒত প্লাস্টিকের জারগুলো হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড দিয়ে জীবাণুুমুক্ত করতে হয়। অনুমোদিত কারখানায় জার পরিষ্কারকযন্ত্র রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অনুমোদনহীন কারখানাগুলোয় জার পরিষ্কারকযন্ত্র দূরের কথা, সরজমিনে দেখা গেছে অধিকাংশেরই ইউভি মেশিন নেই। যাদের আছে সেগুলোয় দীর্ঘদিনের পুরনো ‘ভাল্ব’ ব্যবহার করার কারণে কার্যত পানি জীবাণুমুক্ত হয় না।
সহকারী পরিচালক জানান, পরিশোধন প্রক্রিয়ার আরেকটি অংশ হচ্ছে ‘রিভার্স অসমোসিস’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানিতে থাকা আর্সেনিক, জিংক, কপার, লোহা ও সিসার মতো খনিজ পরিশোধন করা। অবৈধ কারখানাগুলোয় এটিও করা হয় না। দেখা গেছে, এসব কারখানায় ওয়াসার পাইপলাইনের পানিতে স্রেফ আয়োডিন ট্যাবলেট মেশানো হয়। জীবাণুনাশক ব্যবহার করে বোতল বা জার পরিষ্কার করা হয় না। ফুড গ্রেডেড ও স্বচ্ছ প্লাস্টিকের বদলে ক্ষতিকর পিভিসিতে বানানো বোতলে পানি বাজারজাত করা হয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের সহকার অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জানান, মানুষের শরীরে শতকরা ৮০ ভাগ রোগের উৎস পানিবাহিত জীবাণু। এ থেকে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড ও হেপাটাইটিসের মতো রোগের সৃষ্টি হয়। পানিতে লৌহজাত পদার্থ বেশি হলে কিডনির জন্য ক্ষতিকর ও আর্সেনিক দূষণ থেকে মারাÍক চর্মরোগ হয়। তাই যথাযথভাবে পানি পরিশোধিত না হলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পিপাসা, লারিবা, আর্ক, পিউর, সাফাসহ ৭০টির বেশি অবৈধ কারখানার প্রতিটি প্রতিদিন কমপক্ষে ৬০০ জার (প্রতি জার ১৯ লিটার) পানি বিক্রি করে। বাকি অর্ধশত কারখানার সামর্থ্য কম। এরা গড়ে ৩০০-৪০০ জার বিক্রি করে। গড়ে প্রতি কারখানায় ৫০০ জার হিসাবে অনুমোদনহীন কারখানা থেকে প্রতিদিন ৬০ হাজার জার বা ১১ লাখ ৪০ হাজার লিটার পানি বিক্রি হয়। চিটাগং ড্রিংকিং ওয়াটার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, ১৫টি বৈধ কারখানা দিনে গড়ে ১ লাখ লিটারের কিছু বেশি পানি বিক্রি করে।
মন্তব্য করুন