চাঁদার বিনিময়ে ‘কার্ড সিস্টেম’ চালু
অনুমতি না থাকলেও রাজধানীতে দেদারসে চলছে মোটর-রিক্সা। চাঁদার বিনিময়ে এ ‘অনুমতি’ দিচ্ছে একটি চক্র। নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে রিক্সাগুলোর চলাচলের সীমানাও। অভিযোগ উঠেছে, দালালের মাধ্যমে এভাবে টু-পাইস কামিয়ে নিচ্ছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে ডিএমপি ট্রাফিকের তরফে তা অস্বীকার করা হয়েছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ি থেকে মিরপুর, গাজীপুর থেকে কাকরাইল, সায়েদাবাদ থেকে গাবতলী পর্যন্ত সর্বত্রই অবাধে চলাচল করছে পরিবেশবান্ধব এসব মোটরচালিত রিক্সা। ট্রাফিক পুলিশ, সার্জেন্ট ও দালালরা টাকা নিয়ে এর চালকদের দিচ্ছে নিজস্ব পাশ কার্ড। ভিজিটিং কার্ডের মতো দেখতে এসব কার্ড দেখালেই মোটর-রিক্সা চালকদের মুক্তি মেলে ট্রাফিক পুলিশের হাত থেকে। চলাচলের পরিধি এবং ক্ষমতার র্যাংক অনুসারে এসব কার্ডের মাসিক চার্জও হয় ভিন্ন ভিন্ন। নগরীতে এসব রিক্সার চলাচলের ক্ষেত্রে জটিলতা শুরু এর মোটরের কারণেই। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) রিক্সা-ভ্যান চলাচলের লাইসেন্স দিয়ে থাকে। কিন্তু ব্যাটারিচালিত মোটর থাকায় এসব রিক্সা চলাচলের অনুমতি দেওয়ার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাই এসব মোটর রিক্সা চলাচলের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে ডিসিসি সূত্র। প্রথম দিকে বিষয়টি ট্রাফিক পুলিশের নজরে না এলেও, এখন দালালের মাধ্যমে এই কার্ড-ব্যবস্থা চালু করে চাঁদা আদায় করার এক নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে ডিএমপি ট্রাফিক পুলিশ।
রাজধানীর মিরপুর, তেঁজগাও, কাকরাইল, নীলক্ষেত এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, বেশ কয়েক বছর ধরে এই যন্ত্র চালিত রিক্সা (মোটর-রিক্সা) রাজধানীতে চলাচল শুরু করেছে। বাজার থেকে ইলেক্ট্রনিক মোটর সংগ্রহ করে এই রিক্সাগুলোর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এই মোটরটি রিক্সায় রাখা ব্যটারির সাহায্যে ঘুরে রিক্সাকে চলতে সাহায্য করে, যা একজন চালক তার ব্রেকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এছাড়াও, পা দিয়েও রিক্সাটি চালানো যায়। যান্ত্রিক সুবিধার কারণে এ রিক্সাগুলোর দিকেই এখন বেশি করে ঝুঁকে পড়েছে রাজধানীর রিক্সাচালকরা।
সূত্র জানায়, তেঁজগাও, আজিমপুর, লালবাগ, মিরপুর, রামপুরা, বাড্ডা, মেরুল বাড্ডা, যাত্রাবড়ি, বংশাল, খিলগাঁওসহ পুরো শহরজুড়েই চলছে এই মোটর-রিক্সা। এসব রিক্সা চলাচলের জন্য মাসিক হারে সাত’শ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা পর্যন্ত মাসিক চার্জ আদায় করে থাকে ডিএমপি ট্রাফিক পুলিশ ও তাদের নির্ধারিত দালালরা। তবে এলাকা অনুসারে খানিকটা তারতম্য রয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় এই চার্জ বারোশ’ থেকে পনেরোশ’ টাকাও হয়ে থাকে। এসব কার্ডের নিয়ন্ত্রণ থাকে প্রত্যেকটি এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক ইন্সপেক্টরের (টিআই) হাতে। নিয়মিত মাসোয়ারা যায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সার্জেন্টদের পকেটেও। সূত্র জানাচ্ছে, পদাধিকারের কারণে এই সার্জেন্টদের দেওয়া পাশকার্ডই বাজারে সবচেয়ে দামি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মোটর-রিক্সাচালক জানান, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্ত্বর এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) জামিল এবং সঙ্গীয় দালাল চক্রের রনি ও শফিকের নামে এসব কার্ড বিতরণ করা হয়। মিরপুর বাংলা কলেজের এক ছাত্রলীগ নেতার নামেও এসব কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। দেখা গেছে, ভিজিটিং কার্ড আকৃতির এসব কার্ডে দালালদের ফোন নম্বর এবং ক্ষেত্র বিশেষে ডিএমপি ট্রাফিক পুলিশের ব্যাক্তিগত কয়েকটি ফোন নম্বর লেখা রয়েছে। কোনো কোনো কার্ডে (টাইগার) একটি রেজিষ্ট্রেশন নম্বরও রয়েছে। সামনের দিকে রয়েছে বাঘ, ফুল অথবা পাখির ছবি। কার্ডের পিছনের দিকে ‘রনি’, ‘শ’, ‘জেড’- এসব সংকেত লেখা রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন সংকেত ও নাম সম্বলিত এসব কার্ডের মাসিক চার্জ আট’শ টাকা থেকে শুরু করে পনেরোশ’ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ফোন করা হয় ‘জামিলের কার্ড’ হিসেবে পরিচিত একটি কার্ডে দেওয়া নাম্বারে। টিআই জামিল কিনা জানতে চাইলে জানান হয়, তার নাম জামিল। তিনি একজন শ্রমিক নেতা। মিরপুর অঞ্চলের ছোট ছোট যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ তারই হাতে। তার নামের কার্ড থাকলে পুলিশ কেন এসব গাড়ি আটকায় না, তা তার জানা নেই। তবে এসময় প্রতিবেদককে ‘চায়ের দাওয়াত’ দেন জামিল। জানান, তার অফিস মিরপুর-১০ এর গোলচত্ত্বরে।
এ ব্যাপারে মিরপুর এলাকার মোটর-রিক্সাচালক নজরুল ইসলাম বলেন, টাইগার কার্ডটির জন্য মাসিক এক হাজার টাকা দিতে হয়। এ কার্ডগুলোর ব্যবস্থা গ্যারেজ মালিকরাই করে দেন। এছাড়াও, পাখি কার্ডটির জন্য বারো’শ টাকা, ফুল কার্ডটির জন্য পনেরো’শ টাকা মাসিক চার্জ দিতে হয়। এ মাসে এই হারেই চলছে। আগামী মাসে তা আরো বাড়তেও পারে বলে জানান নজরুল।
কাকরাইল এলাকার চালক শাজাহান মিঞা জানালেন প্রায় একই ধরনের তথ্য। এছাড়াও, কথা হয় লালবাগ থেকে নীলক্ষেত এলাকায় আসা মোটর-রিক্সাচালক হামেদুল ইসলামের সঙ্গে। তারা জানান, মোটর-রিক্সাগুলো ব্যাটারির মাধ্যমে চার্জে চলে। প্রতিদিন গ্যারেজে চার্জের জন্য মাসিক দিতে হয় পনেরা’শ টাকা। এছাড়াও, পাশ কার্ডের জন্য মাসিক এক হাজার থেকে পনোরো’শ টাকা দিতে হয়। এর মধ্যেও রয়েছে জমা। সংসার চালানোই কষ্ট। তারা আরো জানান, প্রথম দিকে যখন এ রিক্সা চলাচল শুরু হয় তখন রাস্তায় কোনো বাধা ছিল না। কিন্তু রিক্সার সংখ্যা রাস্তায় বাড়তে শুরু করাতেই বিপত্তি দেখা দেয়। ট্রাফিক পুলিশ রাস্তায় এ রিক্সা আটকাতে শুরু করে এবং টাকার বিনিময়ে আবার ছেড়েও দেয়। ধীরে ধীরে এখন এটি পাশকার্ডের মাধ্যমে চলাচলের অনুমতি পয়েছে। এ ব্যাপারে ডিএমপি ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের উপ কমিশনার (ডিসি) খান মোহাম্মদ রেজোয়ান বলেন, আমার এলাকায় এ ধরনের কোনা কার্ড সিস্টেম চালু আছে বলে জানা নেই। তবে আপনার নজরে এলে আমাকে জানালে আমি ব্যবস্থা নেবো। ট্রাফিক তেজগাঁও জোনের সহকারি কমিশনার (এসি) নজরুল ইসলাম বলেন, আমার এলাকা ভিআইপি জোন। এ জোনে এ ধরনের রিক্সা চলাচলের প্রশ্নই ওঠে না। এসব রিক্সা রাস্তায় চলার কোনো অনুমতি নেই। পাশকার্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা আছে বলে আমার জানা নেই। কোন টিআই ও কোন দালাল এসব কার্ড দেয় জানতে চান তিনি। জানাতে পারলে তিনিও ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
মন্তব্য করুন